ডায়রীর পাতা থেকে

ডায়রীর পাতা থেকে

ডায়রীর পাতা থেকে

আজ ১৬ই ডিসেম্বর। জাতীয় বিজয় দিবস। আমি ও দাদু প্রতিদিন ভোরে লাইব্রেরিতে বই পড়ি। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। লাইব্রেরি ঘরে ঢুকে দেখি দাদু পত্রিকা পড়ছে। আমাকে দেখে পত্রিকাটি সরালেন। আমি বললাম
-    গুড মোর্নিং দাদু।
-    গুড মোর্নিং দাদু ভাই।
আমি বইয়ের তাক থেকে বই বাছাই করছি। দাদু আমার পাশে এসে দাঁড়াল। দাদু একটা ডায়রী নিল। ডায়রীটা আমার হাতে দিয়ে বলল
-    দাদু ভাই আজ বিজয় দিবস। বাঙালির মুক্তির দিন। আজ বিজয়ে অতীত কাহিনী পড়।
আমি ডায়রীটা নিয়ে চেয়ারে বসলাম। দাদু চলে গেল। ডায়রীটা পুরানো। ডায়রীটা একটি মেয়ের। নাম শশী। বয়স ১৫। ডায়রীটার ভিতরের কিছু অংশ তার শৈশবের কথা লেখা। আরও কিছু পাতা উল্টিয়ে আমার চোখ একটি পাতায় আটকে গেল। ডায়রীর পাতার শিরোনাম ৫২এর ভাষা আন্দোলন। তারপর যথাক্রমে কিছু শিরোনাম এই রকম ৫৪ ও ২১ দফা। ৫৮ এ আইন জারী। ৬৬ এর ৬ দফা। ৬৯ এ গণঅভ্যুত্থান। আমি আরও কিছু পাতা উল্টালাম। আবার আমার চোখ আটকে গেল এবং প্রবলভাবে আকর্ষণ করল পাতাটি। পাতার উপরে কালো কালো দাগ। এগুলো রক্তের শুকানো দাগ। পাতাটি পড়া যাচ্ছে না। কষ্ট করে পড়লাম। ডায়রীর পাতাটি এইভাবে সাজানো-

১৮.১০.৭১


একটি বিকাল

   কোন এক সুন্দর বিকেলে, ছিল পাশে সকলে
                        মিষ্টি সেই সময়টুকু থাকবে মনে আজীবন
            অদূর কোন ভবিষ্যতে বিকেলটি মনে হবে যখন তখন
                        ক্লান্ত সেই বিকেলে পাশে ছিল সকলে
 সকল মনের ক্লান্তি দূর হল স্বল্প সেই মুহুর্তে
                        জনবহুল ব্যস্ত শহরে ক্লান্ত বিকালে
                        ক্লান্ত মনে পাখির সরল কলহল
                        গল্প গুজবে মন ছিল আনন্দে
                        ছোট সেই সময়টা থাকবে মনে সানন্দে
গেটে টোকা পড়ল আমি কবিতাটি অসামপ্ত রেখেই উঠলাম। গেট খুলে দেখি ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। ভাইয়াকে দেখে আমার আনন্দের কোন সীমা রইল না। আমার চোখে জলে ভরে গেল। এত আনন্দ হচ্ছে যে,আনন্দে আতহারা হয়ে গেলাম। কি যে করব তা ভেবে পাচিছলাম না। আমরা ভাবতেও পারিনি ভাইয়াকে দেখতে পাব। ভাইয়া মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছে। মুক্তিবাহিনীরা জীবন বাজি রেখে মৃত্তিকার জন্য যুদ্ধ করে। কেউ বেঁচে থাকে আবার কেউ ঢলে পরে মৃত্যুর কোলে। ভাইয়া ঘরে ঢুকল। মা ভাইয়াকে দেখেতো কেদেঁই দিল। মা ভাইয়ার জন্য খাবার আনতে গেল। বাবা কথা বলছে ভাইয়ার সাথে। হঠাৎ প্রচন্ড কোষাঘাত পরল গেটে। আমি গেট খুলে দেখি কয়েকজন পাক-সৈন্যরা দাঁড়িয়ে আছে। তারা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকলো। বাবা উঠে দাঁড়ালেন। ভাইয়া পাকরা আসার আগেই আমার ঘরে চলে গেল। মা ভাইয়ার জন্য খাবার আনলেন। পাকরা মার হাতের বাটি লাথি মেরে ফেল দিল। একজন মার চুলের মুটি ধরলেন। আরেকজন আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বাবা এগিয়ে এল।একজন পাক সেনা কুত্তারা বাবার বুকে গুলি করেল।সাথে সাথে বাবা মাটিতে পওে গেল বাবা মারা গেল। মাকে বন্দুরেক বাট দিয়ে বাড়ি মারল। মার মাথা দিয়ে রক্ত পরছে। মা অজ্ঞান হয়ে গেল। তারপরও কুত্তার দলেরা ছাড়ল না মাকে। মার বুকে একে একে বারি মারল বন্দুরেক বাট দিয়ে। মাও চলে গেল আমাকে একা রেখে। তারপরও ক্ষান্ত হয়নি শুয়োরের বাচ্চারা। পাক বাহিনীরা আমাকে একটি ঘরে নিয়ে গেল। আমি ছিলাম ওদের মেয়ের বা বোনের মতো একটি কিশোরী মেয়ে। কিন্তু শুয়োরের জাত কি মানে সেই সম্পর্ক? ওরা একে একে সাতজন আমার উপরে চালিয়েছে পাশবিক নির্যাতন। আমার সর্বনাশ করেও ক্ষান্ত হয়নি ওরা। আমাকে নিয়ে গেল ওদের ক্যাম্পে। সে কি নির্যাতন। যা লিখে বুঝাবার ক্ষমতা নেই কোন লেখকের। প্রকাশ করার মত কোন ভাষা নেই। ওরা আমাকে তিনদিন পরে রেহাই দিল। কিন্তু লাভ কি হল? আমি তো একটি জীবন্ত লাশ হয়ে গেলাম। এই পাপ বয়ে বেরাব সারা জীবন। আমি বাড়ি ফিরলাম। বাবা মার লাশ নেই। হয়তো বা প্রতিবেশীরা কবর দিয়েছে। আমি আমার ঘরে গেলাম। ভাইয়া আসেনি। আসলে হয়তো আমার ডায়রীটা আগের জায়গায় থাকত না। আমি ডায়রীটা খুললাম। আমার অসমাপ্ত কবিতাটি সমাপ্ত করছি আপনাদের জন্য। আমি ডায়রীতে এই আমার কলংকের কথা লিখলাম। বাঙ্গালির পরের প্রজন্ম যেন দেখতে পারে। বুঝতে পারে। পাক-সৈন্যদের নির্যাতন কত ভয়ংকর ছিল। কতটা অমানুষ ছিল পাক বাহিনী। আমার অসমাপ্ত কবিতাটি হল-

                         আজ নেই সেই বিকেল, হয়েছে অতীত
     আজও চোখে ভাসে সেই দিন, রবে অমলিন
                         আদৌ কখনও আসবে কি সেইদিন
                         অপেক্ষায় রব চিরদিন।
হঠাৎ পিছনে শব্দ হল। দাদু ঘরে ঢুকল। দাদু এসে আমার পাশের চেয়ারে বসল। আমি বললাম,
-দাদু এই ডায়রীটা কার?
-ঐ ডায়রী দাদু ভাই? কিছুক্ষণ থেমে দাদু বলল, ওটা হল তোমার দাদি মানে আমার বোনের।
দাদুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। দাদু হাতের রুমাল দিয়ে পানি মুছল। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম,
-তারপর কি হল? দাদি এখন কোথায়?
-তোমার দাদি আমাদের (বাঙ্গালির) হৃদয়ে। সে গত হয়েছে (আত্মহত্যা  করেছে)। ডায়রী লিখে কিছুক্ষণ পরেই।আমার সাথে আর দেখা হয়নি।
সে তার লেখা পাতার কথা ছাড়া আর কিছুই রেখে যায়নি। অসমাপ্ত রেখে চলে গেল তার ডায়রির পাতা।
 

 মুহাম্মদ সাইদুল শকিদার রণি

Post a Comment

0 Comments