গুপ্ত ঘাতক-০১
॥এক॥
বারান্দায় বসে দৈনিক পত্রিকা পড়ছে সাঈফ। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। অনিচ্ছ্বাস্বত্তে উঠে গেল রিসিভার তুলতে। রিসিভার তুলল সাঈফ।
“হ্যালো। সাঈফ?’’ গম্ভীর একটি কন্ঠস্বর। চিন্তে অসুবিধা হলো না সাঈফের। কমিশনার সাইয়্যেদুর রহমান।
“ইয়েস স্যার।’’
“এখুনি অফিসে চলে এসো।” বলে লইন কেঁেট দিল।
জরুরী বুঝতে পেরেছে সাঈফ। তাই তাড়াতাড়ি পোশাক পরে চলে এল অফিসে। সাঈফকে দেখে উঠে দাঁড়াল রোকেয়া। তিন বছর হল এই ব্রাঞ্চে কাজ করছে ও। অসহায় একটি মেয়ে। বাবা নেই। বিয়ে করেনি। মা,ভাই-বোনকে নিয়ে থাকেন। তবে হাসি-খুশি থাকে সব সময়।
“স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। ” মিষ্টি করে একটি হাসি উপহার দিল মেয়েটি।
সাঈফ আর দাঁড়াল না। সোজা চলে গেল কমিশনারের চেম্বারে।
“আসতে পারি স্যার?”
“ইয়েস।”
ভিতরে ঢুকলো সাঈফ। চেয়ারে বসে আছে কমিশনার। সামনে একটি ফাইল। লাল মোঁড়ক দিয়ে মোড়ানো। লম্বাচুরা। গোলগাল। স্বাস্থ্যবান। বয়স প্রায় ষাটের কাছে। কিন্তু দেখলে মনে হয় চল্লিশ। হাসিমাখা মুখ আজ গম্ভীর। ঠোঁটের কিনারায় সিগারেট। থমথমে চেহারা নিয়ে বসে আছে। ইশারায় বসতে বলল সাঈফকে। একটি চেয়ার টেনে বসল সাঈফ। সাঈফের দিকে ফাইলটা এগিয়ে দিল। পাঁচ মিনিট নিঃশব্দে ফাইলটা পড়ল সাঈফ। ফাইল এভাবে সাজানো হয়েছে।
একটি লাশ পাওয়া গেছে। লাশটির বিবরণ-
ক্স নাম- শিল্পি আক্তার।
ক্স বয়স- ২২ বছর।
ক্স লাশ পাওয়ার স্থান- বাঘাপুর ঝিলে।
ক্স বাসা- রামপুরা ভূঁইয়াপাড়া,হল্ডিং নং ২২২।
ক্স পেশা-ছাত্রী (বাংলা বিভাগ ফাইনাল ইয়ার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)।
ডাক্তারী রির্পোট-
ক্স খুন হয়েছে- তিন দিন আগে। অর্থাৎ ২৬ সেপ্টেম্বার।
ক্স সময়- রাত সাড়ে এগারটা।
ক্স মৃত্যুর কারণ- শ্বাসরোধ করে।
পারিবারিক সূত্র-
ক্স বাসার সবাই বেড়াতে গিয়েছিল। বাসায় ছিল শিল্পি ও কাজের একটি মেয়ে। পরেরদিন এসে শোনে একটি ফোন পেয়ে বাসা থেকে চলে যায়। রাতে আর ফেরেনি। বাসার লোক রামপুরা থানায় একটি ডায়েরী করেন।
পুলিশের সূত্র-
ক্স লাশ উদ্ধার- ডায়েরী করার দুদিন পর।
ক্স সন্ধান- স্থানীয় লোকজন দেখে পুলিশকে খবর দেয়।
ক্স সূত্র- গলায় হাতের ছাপ ও একটি রুমাল।
ফাইল থেকে চোখ তুলে কমিশনারের দিকে তাকাল।“কোনো সূত্র নেই। আর বুড়ো বসে বসে বগা টানছে।”মনে মনে বলল সাঈফ। চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গেল কমিশনার। জানালার দিকে মুখ করে বলতে শুরু করল।
“এখন পর্যন্ত কোনো আসামী চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। তাই আমি চাই এই কেসটা তুমি দেখ। আমি জানি তুমি পারবে।” কথা শেষ করে কয়েকটা টান দিল সিগারেটে।
“লাশটা এখন কোথায়?” মুখ খুলল সাঈফ।
“ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে।”
“আমি কি এখনই নামব?”
“অবশ্যই। তোামাকে স্থাণীয় পুলিশ সাহায্যে করবে।”
ধন্যবাদ দিয়ে বেড়িয়ে এল সাঈফ।
॥দুই॥
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ। সাঈফ কথা বলছে মর্গের প্রহরীর সাথে।
“আজ শিল্পি নামের একটি মেয়ের লাশ এসেছে। আমি কি লাশটা দেখতে পারি?”
“ কে আপনি? লাশ দেখতে আইছেন। মর্গে ঢোকা যাইব না।”
“ভাই আপনে বোঝার চেষ্টা করেন। আমি একবার দেখে চলে যাব। মাত্র পাঁচ মিনিট সময় লাগবে।”
“অনুমতি নিয়া আহেন।” প্রহরী আরেক দিকে চলে গেল।
প্রহরীকে দিয়ে কোনো কাজ হবে না । তাই তাকে যেতে হবে মর্গের কর্মরত অফিসারের কাছে। সাঈফ অফিসারের কক্ষে প্রবেশ করল। খাটো। হ্যাংলা। মোচ আছে। দাঁড়ি কামানো। চেয়ারে বসে আছে। সাঈফের কাছ মনে হল একটি শিশু চেয়ারে বসে আছে। হাসি খুসি। খুব বিনয়ী মানুষ। সাঈফ কক্ষের চারপাশ দেখে নিল। নোংরা। এখানে সেখানে ফাইল পরে আছে। মর্গের অফিসারের টেবিলের সামনে গেল সাঈফ। চোখ তুলে তাকাল অফিসার। সাঈফ পরিচয় দিল। সাঈফের কথা শুনে যেন বোবা বনে গেল অফিসার। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন।
“ আমি সুলতান মাহমুদ। কি করতে পারি স্যার আপনার জন্য?”
“মর্গে আজ একটি লাশ এসেছে। আমি সেটা দেখতে চাই। আপনে যদি অনুমতি দেন?”
“আমার কোনো আপত্তি নেই।”
“প্রহরী ভিতরে ঢুকরে দিচ্ছে না। তাই আপনি যদি এটু দয়া করে লিখে দেন।”
“আমি নিজে আপনার সাথে যাব। চলুন স্যার।” চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন অফিসার।
মর্গের কাছে চলে এসেছে ওরা। থেমে গেল অফিসার। প্রহরী গেট খুলল। সাঈফ ভিতরে ঢুকল। অফিসার বাহিরেই দাঁড়িয়ে রইল। তিন নাম্বারে রাখা হয়েছে শিল্পি নামের একটি লাশ। লাশটির পাশে এসে দাঁড়াল সাঈফ। পর্দা সরালো সাঈফ। সরল একটি মুখ। প্লাস্টিক পুতুলের মতো আঁকা দুটি চোখ। ছোট ছোট ঘন লিপস্টিক মাখা ঠোঁট। দুই বেণী করা। এটি যে একটি শুধু দেহ তা মনেই হয় না। যেন সরল মেয়েটি ঘুমিয়ে আছে। পর্দা সরালো সাঈফ। গলায় হতের অস্পষ্ট ছাপ। তা দিয়ে আসামি চিহ্নিত সম্ভব না। আর কিছু পাওয়া গেল না। পর্দা দিয়ে ঢেকে দিল আবার। বেড়িয়ে এল বাহিরে সাঈফ। এখনো দাঁড়িয়ে আছে অফিসার। সাঈফকে দেখে একটা হাসি দিল।
“স্যার এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল?”
“হ্যা।” সংক্ষিপ্তে জবাব দিল সাঈফ।
ধন্যবাদ দিয়ে বেড়িয়ে এল রাস্তায়। চিন্তা করছে কি করবে এখন। হঠাৎ মনে পরে গেল। শিল্পি ফোন পেয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে যায়। তাহলে ফোনটা করল কে? একটি সি.এন.জি. ডাকল। চলতে শুরু করল সি.এ.জি.।
॥তিন॥
হল্ডিং নং২২২,ভূঁইয়াপাঁড়া রামপুরা। বাড়ির কলিং বেল বাজাল সাঈফ। কোনো সাড়া নেই। আবার বাজাল। এবার কাজ হল। গেট খুলল রামপুরা থানার কনেস্টবল মোস্তাফা জব্বার।
“কে আপনি? কাকে চান?” পরিচয় জানতে চাইল কনেস্টবল।
“আমি সাঈফ খান। ডিটেকটিভ অফিসার।” আইডি কার্ড দেখাল সাঈফ।
“সরি স্যার। ভিতরে আসুন।”লজ্জিত কন্ঠে বলল কনেস্টবল।
ভিতরে ঢুকল সাঈফ। কনেস্টবলের পিছনে পিছনে চল সাঈফ। বসার ঘরে ঢুকল কনেস্টবল। সাথে সাঈফ। বসার ঘরে শিল্পির বাবা-মা, ভাই-বোন,দাদি ও একজন দারোগা বসে আছে। সবাই কাঁদছে। অফিসার ও শিল্পির ভাই তাকাল সাঈফের দিকে। পরিচয় করিয়ে দিল কনেস্টবল। উঠে দাঁড়াল দারোগা।
“স্যার আপনি আসবেন। আমরা সেই খবর পেয়ে এখানে এসেছি।”
“আপনি দারোগা মেহেদী হাসান?”
“জি স্যার।” বিনয়ী একটি হাসি দিল দারোগা।
আর কোনো কথা বলল না সাঈফ। বসল একটি সোফায়। ঘরটাকে একবার চোখ বুলাল। ঘরটিকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। মেঝেতে দামী কার্পেট। দেয়ালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,কাজী নজরুল,জসিম উদ্দিন,হুমায়ূন আজাদ ও আরও অনেকের ছবি টানানো। শিল্পি বাংলার ছাত্রী ছিল তাই। সাঈফ যেখানে বসেছে তার পাশে একটি ছবি। ছবিটি শিল্পির। এখনো কাদঁছে শিল্পির বাবা-মা। শিল্পি এই পরিবারের বড় মেয়ে। ঘাতকরা এই পরিবারে কাল মেঘ দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। কেরে নিয়েছে এই পরিবারের সুখ। শিল্পির বাবা মোশারফ আলম একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসার জন্য পরিবারে সময় দিতে পারতেন না। আজ মেয়ে নেই। আজ তাই সুখের বুকে কালো ছায়া নেমেছে। নড়ে বসল সাঈফ। মুখ খুলল সাঈফ।
“ মি. আলম। কাদঁলে আপনার মেয়েকে আর ফেরত পাবেন না। তার চেয়ে আমাদের কাজে সাহায্যে করুন।”
“আমরা আপনাদের কি সাহায্যে করতে পারি?”
“রির্পোটে বলা হয়েছে। শিল্পি ফোন পেয়ে বাসা থেকে বেড়েয়ে যায়। ফোনটা করল কে?”
“সেটা তো স্যার বলতে পারব না।” বললেন শিল্পির বাবা।
“মি.হাসান। আপনারা কি জানতে পেরেছেন? ফোন কে করেছে?” পুলিশ দারোগা দিকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করল।
“না স্যার। আমরা জানতে পারিনি।”
“বাসায় যে মেয়েটা ছিল। সে কিছু বলেনি?
“জি না স্যার। সেও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।”
“সেই মেয়েটাকে ডাকেন। আমি ওর সাথে এটু কথা বলব।”
কনেস্টবল বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। কিচুক্ষণ পর একটি মেয়েকে সাথে নিয়ে ঢুকল ঘরে। মনে হচ্ছে মেয়েটা প্রচুর ভয় পেয়েছে। সাঈফের সামনে এসে দাঁড়াল মেয়েটি।
“বসো। কি নাম তোমার?” সোফার এক পাশে বসতে বলল সাঈফ।
“আয়শা।”
“সেই দিন রাতে যে ফোন করে ছিল। তাকে তুমি চেন?”
“জি না।”
“যাবার সময় তোমাকে কিছু বলে যায়নি?”
“বলেছিল। আসতে দেরি হবে।”
“আমি শিল্পির রুমটা একবার দেখব। চলুন মি.হাসান।”
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সাঈফ। শিল্পির শোবার ঘর দেখতে চলল। রুমের গেট খুলল আয়শা। ভিতরে ঢুকল সাঈফ,দারোগা ও শিল্পির বাবা। আয়শা বাহিরে দাঁিড়য়ে রইল। শিল্পির ঘরটিও গুছানো। ঘরে ঢুকতে ডান পাশে একটি ওয়াকডব। পাশে মেকাব আঁয়না। ঘরে ঢুকতে বাম পাশে সুকেস্ট। জানালার পাশে খাট। খাটের পায়ের কাছে পড়ার টেবিল। টেবিলের উপর খোলা একটি প্যাড। সাঈফ প্যাডটা হাতে নিল। পাশে একটি খোলা কলম। তাড়াহুরা করে কিছু লিখেছিল।
“পেন্সিল হবে মি.হাসান?”
“জি স্যার।”
দারোগার কাছ থেকে পেন্সিল নিল। র্স্পষ্ট করল লেখাটি। একটি মোবাইল নাম্বার। টেবিলে আর কিছু পাওয়া গেল না। ওয়াকডবের ডোয়ার খুলল দারোগা। কিছু প্রেমপত্র পেল। মেয়ে চরিত্রে শিল্পি আর ছেলে চরিত্রে সাইমুম। আর কিছু পাওয়া গেল না। বেরিয়ে এল সবাই।
“আচ্ছা মি.আলম। সাইমুম কে?”
“শিল্পির ব›ধু। প্রায় আসত এই বাড়িতে।”
“এই নাম্বারটা চেনেন?” নাম্বার দেখাল শিল্পির বাবাকে।
“হ্যা। এটা তো সাইমুমের নাম্বার। তাহলে কি আমার মেয়েকে সাইমুমই.......।” আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন শিল্পির বাবা।
নাম্বারটায় ডায়াল সাঈফ। রিং হচ্ছে। কল রিসিভ করল না। আবার ডায়াল করল। এবার বাজার সাথে সাথেই কল রিসিভ হল।
“হ্যালো । কে বলছেন?” ওপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল একটি পুরুষ কন্ঠ।
“আমি সাঈফ। শিল্পির বন্ধু। আপনার নাম সাইমুম?”
“জি। কিন্তু আমার কাছে ফোন করেছেন কেন?”
“শিল্পি আমকে এই নাম্বারটা দিয়েছে। আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। আমি কি আপনার সাথে দেখা করতে পারি?”
“কি কথা?”
“সেটা সামনা সামনি বলব।”
“আচ্চা আসেন।”
“আপনার ঠিকানাটা?”
“২০৮/বি, নতুন রাস্তা,মধুবাগ।”
“ধন্যবাদ। আবার দেখা হবে।”অপর প্রান্ত থেকেই লাইন কেঁেট দিল।
বসার ঘরে ঢুকল সাঈফ। এখনও কাঁদছে আলম সাহেব। সবার কাছ থেকে বিদয় নিয়ে বাহিরে এল সাঈফ। সাথে দারোগাও বাহিরে এল।
“মি. হাসান। প্রয়োজন হলে আমি আপনাকে ডাকব। ততক্ষণ আপনি এখানে থাকবেন।”
“জি স্যার।”
এখন পর্যন্ত জানা যায়নি কে খুনি। সূত্র বলতে সাইমুম। আর কেনো সূত্র নেই। সাইমুমের কাছে গেলে কি পাবে কোনো সূত্র। নাকি সাইমুমি খুন করেছে শিল্পিকে। সাঈফ কি দেখবে সাইমুম ওর জন্য অপেক্ষা করছে? নাকি সাইমুম পালাবে। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে সাঈফ। কোনো সি.এন.জি. নেই। তাই একটি রিক্সায় উঠে পরল।
॥এক॥
বারান্দায় বসে দৈনিক পত্রিকা পড়ছে সাঈফ। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। অনিচ্ছ্বাস্বত্তে উঠে গেল রিসিভার তুলতে। রিসিভার তুলল সাঈফ।
“হ্যালো। সাঈফ?’’ গম্ভীর একটি কন্ঠস্বর। চিন্তে অসুবিধা হলো না সাঈফের। কমিশনার সাইয়্যেদুর রহমান।
“ইয়েস স্যার।’’
“এখুনি অফিসে চলে এসো।” বলে লইন কেঁেট দিল।
জরুরী বুঝতে পেরেছে সাঈফ। তাই তাড়াতাড়ি পোশাক পরে চলে এল অফিসে। সাঈফকে দেখে উঠে দাঁড়াল রোকেয়া। তিন বছর হল এই ব্রাঞ্চে কাজ করছে ও। অসহায় একটি মেয়ে। বাবা নেই। বিয়ে করেনি। মা,ভাই-বোনকে নিয়ে থাকেন। তবে হাসি-খুশি থাকে সব সময়।
“স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। ” মিষ্টি করে একটি হাসি উপহার দিল মেয়েটি।
সাঈফ আর দাঁড়াল না। সোজা চলে গেল কমিশনারের চেম্বারে।
“আসতে পারি স্যার?”
“ইয়েস।”
ভিতরে ঢুকলো সাঈফ। চেয়ারে বসে আছে কমিশনার। সামনে একটি ফাইল। লাল মোঁড়ক দিয়ে মোড়ানো। লম্বাচুরা। গোলগাল। স্বাস্থ্যবান। বয়স প্রায় ষাটের কাছে। কিন্তু দেখলে মনে হয় চল্লিশ। হাসিমাখা মুখ আজ গম্ভীর। ঠোঁটের কিনারায় সিগারেট। থমথমে চেহারা নিয়ে বসে আছে। ইশারায় বসতে বলল সাঈফকে। একটি চেয়ার টেনে বসল সাঈফ। সাঈফের দিকে ফাইলটা এগিয়ে দিল। পাঁচ মিনিট নিঃশব্দে ফাইলটা পড়ল সাঈফ। ফাইল এভাবে সাজানো হয়েছে।
একটি লাশ পাওয়া গেছে। লাশটির বিবরণ-
ক্স নাম- শিল্পি আক্তার।
ক্স বয়স- ২২ বছর।
ক্স লাশ পাওয়ার স্থান- বাঘাপুর ঝিলে।
ক্স বাসা- রামপুরা ভূঁইয়াপাড়া,হল্ডিং নং ২২২।
ক্স পেশা-ছাত্রী (বাংলা বিভাগ ফাইনাল ইয়ার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)।
ডাক্তারী রির্পোট-
ক্স খুন হয়েছে- তিন দিন আগে। অর্থাৎ ২৬ সেপ্টেম্বার।
ক্স সময়- রাত সাড়ে এগারটা।
ক্স মৃত্যুর কারণ- শ্বাসরোধ করে।
পারিবারিক সূত্র-
ক্স বাসার সবাই বেড়াতে গিয়েছিল। বাসায় ছিল শিল্পি ও কাজের একটি মেয়ে। পরেরদিন এসে শোনে একটি ফোন পেয়ে বাসা থেকে চলে যায়। রাতে আর ফেরেনি। বাসার লোক রামপুরা থানায় একটি ডায়েরী করেন।
পুলিশের সূত্র-
ক্স লাশ উদ্ধার- ডায়েরী করার দুদিন পর।
ক্স সন্ধান- স্থানীয় লোকজন দেখে পুলিশকে খবর দেয়।
ক্স সূত্র- গলায় হাতের ছাপ ও একটি রুমাল।
ফাইল থেকে চোখ তুলে কমিশনারের দিকে তাকাল।“কোনো সূত্র নেই। আর বুড়ো বসে বসে বগা টানছে।”মনে মনে বলল সাঈফ। চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গেল কমিশনার। জানালার দিকে মুখ করে বলতে শুরু করল।
“এখন পর্যন্ত কোনো আসামী চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। তাই আমি চাই এই কেসটা তুমি দেখ। আমি জানি তুমি পারবে।” কথা শেষ করে কয়েকটা টান দিল সিগারেটে।
“লাশটা এখন কোথায়?” মুখ খুলল সাঈফ।
“ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে।”
“আমি কি এখনই নামব?”
“অবশ্যই। তোামাকে স্থাণীয় পুলিশ সাহায্যে করবে।”
ধন্যবাদ দিয়ে বেড়িয়ে এল সাঈফ।
॥দুই॥
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ। সাঈফ কথা বলছে মর্গের প্রহরীর সাথে।
“আজ শিল্পি নামের একটি মেয়ের লাশ এসেছে। আমি কি লাশটা দেখতে পারি?”
“ কে আপনি? লাশ দেখতে আইছেন। মর্গে ঢোকা যাইব না।”
“ভাই আপনে বোঝার চেষ্টা করেন। আমি একবার দেখে চলে যাব। মাত্র পাঁচ মিনিট সময় লাগবে।”
“অনুমতি নিয়া আহেন।” প্রহরী আরেক দিকে চলে গেল।
প্রহরীকে দিয়ে কোনো কাজ হবে না । তাই তাকে যেতে হবে মর্গের কর্মরত অফিসারের কাছে। সাঈফ অফিসারের কক্ষে প্রবেশ করল। খাটো। হ্যাংলা। মোচ আছে। দাঁড়ি কামানো। চেয়ারে বসে আছে। সাঈফের কাছ মনে হল একটি শিশু চেয়ারে বসে আছে। হাসি খুসি। খুব বিনয়ী মানুষ। সাঈফ কক্ষের চারপাশ দেখে নিল। নোংরা। এখানে সেখানে ফাইল পরে আছে। মর্গের অফিসারের টেবিলের সামনে গেল সাঈফ। চোখ তুলে তাকাল অফিসার। সাঈফ পরিচয় দিল। সাঈফের কথা শুনে যেন বোবা বনে গেল অফিসার। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন।
“ আমি সুলতান মাহমুদ। কি করতে পারি স্যার আপনার জন্য?”
“মর্গে আজ একটি লাশ এসেছে। আমি সেটা দেখতে চাই। আপনে যদি অনুমতি দেন?”
“আমার কোনো আপত্তি নেই।”
“প্রহরী ভিতরে ঢুকরে দিচ্ছে না। তাই আপনি যদি এটু দয়া করে লিখে দেন।”
“আমি নিজে আপনার সাথে যাব। চলুন স্যার।” চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন অফিসার।
মর্গের কাছে চলে এসেছে ওরা। থেমে গেল অফিসার। প্রহরী গেট খুলল। সাঈফ ভিতরে ঢুকল। অফিসার বাহিরেই দাঁড়িয়ে রইল। তিন নাম্বারে রাখা হয়েছে শিল্পি নামের একটি লাশ। লাশটির পাশে এসে দাঁড়াল সাঈফ। পর্দা সরালো সাঈফ। সরল একটি মুখ। প্লাস্টিক পুতুলের মতো আঁকা দুটি চোখ। ছোট ছোট ঘন লিপস্টিক মাখা ঠোঁট। দুই বেণী করা। এটি যে একটি শুধু দেহ তা মনেই হয় না। যেন সরল মেয়েটি ঘুমিয়ে আছে। পর্দা সরালো সাঈফ। গলায় হতের অস্পষ্ট ছাপ। তা দিয়ে আসামি চিহ্নিত সম্ভব না। আর কিছু পাওয়া গেল না। পর্দা দিয়ে ঢেকে দিল আবার। বেড়িয়ে এল বাহিরে সাঈফ। এখনো দাঁড়িয়ে আছে অফিসার। সাঈফকে দেখে একটা হাসি দিল।
“স্যার এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল?”
“হ্যা।” সংক্ষিপ্তে জবাব দিল সাঈফ।
ধন্যবাদ দিয়ে বেড়িয়ে এল রাস্তায়। চিন্তা করছে কি করবে এখন। হঠাৎ মনে পরে গেল। শিল্পি ফোন পেয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে যায়। তাহলে ফোনটা করল কে? একটি সি.এন.জি. ডাকল। চলতে শুরু করল সি.এ.জি.।
॥তিন॥
হল্ডিং নং২২২,ভূঁইয়াপাঁড়া রামপুরা। বাড়ির কলিং বেল বাজাল সাঈফ। কোনো সাড়া নেই। আবার বাজাল। এবার কাজ হল। গেট খুলল রামপুরা থানার কনেস্টবল মোস্তাফা জব্বার।
“কে আপনি? কাকে চান?” পরিচয় জানতে চাইল কনেস্টবল।
“আমি সাঈফ খান। ডিটেকটিভ অফিসার।” আইডি কার্ড দেখাল সাঈফ।
“সরি স্যার। ভিতরে আসুন।”লজ্জিত কন্ঠে বলল কনেস্টবল।
ভিতরে ঢুকল সাঈফ। কনেস্টবলের পিছনে পিছনে চল সাঈফ। বসার ঘরে ঢুকল কনেস্টবল। সাথে সাঈফ। বসার ঘরে শিল্পির বাবা-মা, ভাই-বোন,দাদি ও একজন দারোগা বসে আছে। সবাই কাঁদছে। অফিসার ও শিল্পির ভাই তাকাল সাঈফের দিকে। পরিচয় করিয়ে দিল কনেস্টবল। উঠে দাঁড়াল দারোগা।
“স্যার আপনি আসবেন। আমরা সেই খবর পেয়ে এখানে এসেছি।”
“আপনি দারোগা মেহেদী হাসান?”
“জি স্যার।” বিনয়ী একটি হাসি দিল দারোগা।
আর কোনো কথা বলল না সাঈফ। বসল একটি সোফায়। ঘরটাকে একবার চোখ বুলাল। ঘরটিকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। মেঝেতে দামী কার্পেট। দেয়ালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,কাজী নজরুল,জসিম উদ্দিন,হুমায়ূন আজাদ ও আরও অনেকের ছবি টানানো। শিল্পি বাংলার ছাত্রী ছিল তাই। সাঈফ যেখানে বসেছে তার পাশে একটি ছবি। ছবিটি শিল্পির। এখনো কাদঁছে শিল্পির বাবা-মা। শিল্পি এই পরিবারের বড় মেয়ে। ঘাতকরা এই পরিবারে কাল মেঘ দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। কেরে নিয়েছে এই পরিবারের সুখ। শিল্পির বাবা মোশারফ আলম একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসার জন্য পরিবারে সময় দিতে পারতেন না। আজ মেয়ে নেই। আজ তাই সুখের বুকে কালো ছায়া নেমেছে। নড়ে বসল সাঈফ। মুখ খুলল সাঈফ।
“ মি. আলম। কাদঁলে আপনার মেয়েকে আর ফেরত পাবেন না। তার চেয়ে আমাদের কাজে সাহায্যে করুন।”
“আমরা আপনাদের কি সাহায্যে করতে পারি?”
“রির্পোটে বলা হয়েছে। শিল্পি ফোন পেয়ে বাসা থেকে বেড়েয়ে যায়। ফোনটা করল কে?”
“সেটা তো স্যার বলতে পারব না।” বললেন শিল্পির বাবা।
“মি.হাসান। আপনারা কি জানতে পেরেছেন? ফোন কে করেছে?” পুলিশ দারোগা দিকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করল।
“না স্যার। আমরা জানতে পারিনি।”
“বাসায় যে মেয়েটা ছিল। সে কিছু বলেনি?
“জি না স্যার। সেও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।”
“সেই মেয়েটাকে ডাকেন। আমি ওর সাথে এটু কথা বলব।”
কনেস্টবল বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। কিচুক্ষণ পর একটি মেয়েকে সাথে নিয়ে ঢুকল ঘরে। মনে হচ্ছে মেয়েটা প্রচুর ভয় পেয়েছে। সাঈফের সামনে এসে দাঁড়াল মেয়েটি।
“বসো। কি নাম তোমার?” সোফার এক পাশে বসতে বলল সাঈফ।
“আয়শা।”
“সেই দিন রাতে যে ফোন করে ছিল। তাকে তুমি চেন?”
“জি না।”
“যাবার সময় তোমাকে কিছু বলে যায়নি?”
“বলেছিল। আসতে দেরি হবে।”
“আমি শিল্পির রুমটা একবার দেখব। চলুন মি.হাসান।”
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সাঈফ। শিল্পির শোবার ঘর দেখতে চলল। রুমের গেট খুলল আয়শা। ভিতরে ঢুকল সাঈফ,দারোগা ও শিল্পির বাবা। আয়শা বাহিরে দাঁিড়য়ে রইল। শিল্পির ঘরটিও গুছানো। ঘরে ঢুকতে ডান পাশে একটি ওয়াকডব। পাশে মেকাব আঁয়না। ঘরে ঢুকতে বাম পাশে সুকেস্ট। জানালার পাশে খাট। খাটের পায়ের কাছে পড়ার টেবিল। টেবিলের উপর খোলা একটি প্যাড। সাঈফ প্যাডটা হাতে নিল। পাশে একটি খোলা কলম। তাড়াহুরা করে কিছু লিখেছিল।
“পেন্সিল হবে মি.হাসান?”
“জি স্যার।”
দারোগার কাছ থেকে পেন্সিল নিল। র্স্পষ্ট করল লেখাটি। একটি মোবাইল নাম্বার। টেবিলে আর কিছু পাওয়া গেল না। ওয়াকডবের ডোয়ার খুলল দারোগা। কিছু প্রেমপত্র পেল। মেয়ে চরিত্রে শিল্পি আর ছেলে চরিত্রে সাইমুম। আর কিছু পাওয়া গেল না। বেরিয়ে এল সবাই।
“আচ্ছা মি.আলম। সাইমুম কে?”
“শিল্পির ব›ধু। প্রায় আসত এই বাড়িতে।”
“এই নাম্বারটা চেনেন?” নাম্বার দেখাল শিল্পির বাবাকে।
“হ্যা। এটা তো সাইমুমের নাম্বার। তাহলে কি আমার মেয়েকে সাইমুমই.......।” আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন শিল্পির বাবা।
নাম্বারটায় ডায়াল সাঈফ। রিং হচ্ছে। কল রিসিভ করল না। আবার ডায়াল করল। এবার বাজার সাথে সাথেই কল রিসিভ হল।
“হ্যালো । কে বলছেন?” ওপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল একটি পুরুষ কন্ঠ।
“আমি সাঈফ। শিল্পির বন্ধু। আপনার নাম সাইমুম?”
“জি। কিন্তু আমার কাছে ফোন করেছেন কেন?”
“শিল্পি আমকে এই নাম্বারটা দিয়েছে। আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। আমি কি আপনার সাথে দেখা করতে পারি?”
“কি কথা?”
“সেটা সামনা সামনি বলব।”
“আচ্চা আসেন।”
“আপনার ঠিকানাটা?”
“২০৮/বি, নতুন রাস্তা,মধুবাগ।”
“ধন্যবাদ। আবার দেখা হবে।”অপর প্রান্ত থেকেই লাইন কেঁেট দিল।
বসার ঘরে ঢুকল সাঈফ। এখনও কাঁদছে আলম সাহেব। সবার কাছ থেকে বিদয় নিয়ে বাহিরে এল সাঈফ। সাথে দারোগাও বাহিরে এল।
“মি. হাসান। প্রয়োজন হলে আমি আপনাকে ডাকব। ততক্ষণ আপনি এখানে থাকবেন।”
“জি স্যার।”
এখন পর্যন্ত জানা যায়নি কে খুনি। সূত্র বলতে সাইমুম। আর কেনো সূত্র নেই। সাইমুমের কাছে গেলে কি পাবে কোনো সূত্র। নাকি সাইমুমি খুন করেছে শিল্পিকে। সাঈফ কি দেখবে সাইমুম ওর জন্য অপেক্ষা করছে? নাকি সাইমুম পালাবে। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে সাঈফ। কোনো সি.এন.জি. নেই। তাই একটি রিক্সায় উঠে পরল।
0 Comments